একগুচ্ছ কবিতা- বদরুজ্জামান আলমগীর
মহাভারতের নামে
বড় বড় অভিযোগ জমে উঠেছে সবিতা শোন
বড় সব আজদাহা অভিযোগ পাকিয়ে উঠেছে
আমার ব্যাপারে তোমার- ঠিক আমি হয়তো নই,
তবুও আমাদেরই ব্যাপারে- আমার বংশজ্ঞাতি,
আত্মীয় পরিজন পাড়াপড়শি- তাদের ব্যাপারে
আলিশান সব আপত্তি জমে উঠেছে তোমাদের;
আমাদের মানে আমাদের- নবীজির বংশলতিকা
মুসলমানদের ব্যাপারে তুলেছে নির্মমতার নালিশ।
তোমরা মানে তোমরা- সনাতনী হিন্দুদের নামে
একপাহাড় অভিযোগ খাড়া করেছে আমাদের
মুসলমান জ্ঞাতিজন- তোমরা কখনই আমাদের
হৃদজন ভাবোনি- ভেবেছো চাষাভুষা তফশিল।
জানি আমি অসহায়- দেবার মত কোন যে প্রমাণ
আমার হাতে নাই- আমি বাড়াই সত্য কৃষকের স্মৃতি,
তুমি আমাকে দাও শস্যের দেবতা পঞ্চাননের মাটি
কী চাইবো আর তুমি দাও আমায় মহাভারত নাম
মহাকাব্যের শত কোণ, দুনিয়া ব্যাখ্যা করার চাবিটি।
সক্রেটিস
আমাদের সবার পক্ষ থেকে সক্রেটিস হেমলক
পান করছেন একদম নির্দ্বিধায়, এখনও।
সহজেই সক্রেটিস ক্ষমা পেতে পারতেন
তিনি জানতেন ক্ষমা প্রার্থনা করলে সারাজীবন তিনি
নতজানু হাস্যকর- ক্ষমার বাইরে চলে যাবেন।
সেদিন সক্রেটিসের নামে গোটা মানবজাতি হেরে যেতো
তিনি জিতাতে চেয়েছেন- তার মৃতদেহের উপর
স্থিরিকৃত নুড়িপাথরে- গোটা মানবজাতিকে,
মানুষ আজ এতোটা তারিফ ঘরে তুলতে পারে
সক্রেটিসের মৃত্যুগ্রহণের স্থাপত্যকলায়;
মানবজাতির ইতিহাস আদতে সক্রেটিসের হেমলক
পান করার নির্বিকার কালপুত্র ইতিহাস।
ভেবে দেখি- আমরা কেন লজ্জা পাই,
কেনই বা কুন্ঠিত হই, এভাবে তড়িৎ মুখ ঢাকি প্রতিবার?
সক্রেটিস লজ্জিত ছিলেন- কেননা তিনি মৃত্যুর আগে
ক্রিটোকে বলেছিলেন বাকিতে মুরগি কেনার কথা;
তিনি যে সারাজন্মের মত দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছেন
তার জন্য কোন গ্লানি ছিল না, না ছিল পরাভব।
তিনি ভেবেছিলেন এই হেমলক পানে মৃত্যুই তাঁর উপহার,
আগামী দুনিয়ার পক্ষ থেকে দীপ্তিমান উপঢৌকন।
সক্রেটিস দুনিয়ার সামনে উচ্চতা এবং ঢালু জায়গার
কায়কারবার আর প্যারাডক্স উপস্থিত করেছিলেন।
সবাকেই চ্যালেঞ্জের মধ্যে আবাহন করেছেন সক্রেটিস।
সক্রেটিসই আমাদের জীবনকে মৃত্যুর গরিমায়
শিরদাঁড়া ও নাকফুল পরিয়ে দিয়ে গ্যাছেন।
জীবন নিরাপোস- তাই কস্তুরি নাভির ঘ্রাণে বিপর্যস্ত
হাতের কাছে কোমল- দিগন্তের ওপারে উড্ডীন পাথর।
কাহার পরাণ ওড়ে
ভোরের আলোর নকশিকাঁথায় কাহার পরাণ ওড়ে
একটি হরিণ কাঁপছে ডরে দৃশ্যপটের মোড়ে
ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে বনের মহল্লায়
মনের ভিতর দেবদারু গাছ কুঠারে চমকায়
কাঁপছে আমার পূর্বপুরুষ বসতভিটা জুড়ে
ভোরের আলোর নকশিকাঁথায় কাহার পরাণ ওড়ে
মানুষ কোথায় মানুষ কোথায় নদীর সহোদরে
তোমার দুচোখ ঢেউয়া ফলের পানিতে টলমল
কাটছো আহা গাছের গোড়া কাটছো পদতল
গাছ হয়ে রও নদ হয়ে বও আমার দেহপুরে
ভোরের আলোর নকশিকাঁথায় কাহার পরাণ ওড়ে।
অপেক্ষার বোন
আমি সাধারণত মৃত মানুষের মুখ দেখি না-
প্রাণের দুকূল ছাপিয়ে ভাবি যে,
সামনের নিথর মুখটি একটি স্টিল ছবি
একটি চিত্রকল্প মাত্র- এ সত্য হতে পারে না,
সত্য তার চলাচল, হাসিকান্না, লেনদেন।
আজ আমি কেবল স্তব্ধ হয়ে বসে আছি-
যে চলে গেল আমাদের একা ফেলে
সে বিহনে কীভাবে আমার ছোট ছোট
গ্রামগুলির সাথে দেখা হবে আর!
কীভাবে এই বিদেশ বিভুইয়ে বুঝবো যে,
আমরা শস্যের দানা ও পথের ধূলা মিশানো
হাসির দেশ থেকে এসেছি!
আমার এ নিরবধি সবজি পসারী ভাই
নুয়ে থাকাগুলো থরে থরে সাজিয়ে রাখতো-
শস্য ও খাবার দানার মৃধুলয় শত ভাঁজ
আমাদের শঙ্কিত শৈশব, ঘুড্ডি লাটিমের ঘূর্ণি।
এভাবেই আমরা সবজি ও বিলের ভাই,
আমরা রয়ে রয়ে নুনপানি, অপেক্ষার বোন।
স্ববিরোধ
অদ্ভুত একটা কালের বিবাগী বসতী হয়েছি আমরা
হুহু করে উড়ছে, বাড়ছে মানুষ প্রতিদিন ;
শত থেকে হাজার, হাজার টপকে লাখ
লাখ থুয়ে কোটি, কোটি ডিঙিয়ে মিলিয়ন
মিলিয়ন মাড়িয়ে বিলিয়ন, বিলিয়ন চাপিয়ে ট্রিলিয়ন
মানুষ, মানুষ বাড়ছে দেদারসে দুদ্দাড় প্রতিদিন।
আশ্চর্য স্ববিরোধ এক ঝেঁকে বসেছে সময়ের কাঁধে-
পৈপৈ মানুষ বাড়ছে যতো- ততোই কমে যাচ্ছে মানুষ।
আরো পড়ুন- মির্জা গালিবের কবিতা